বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল, যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অবস্থান। ঠিক সুন্দরবনের পাশে অবস্থিত একটি সংগ্রামমুখর জনপদ দাকোপ। এই দাকোপ উপজেলারই একটি গ্রামে ছিল আমাদের যাত্রা যার নাম নলিয়ান। নলিয়ান গ্রাম অত্যন্ত সুন্দর অথচ সংগ্রামমুখর একটি জনপদ। এখানে মানুষ বেঁচে থাকে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে লড়াই করে। লবণাক্ত পানির ছোবল, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত, বিশুদ্ধ পানির অভাব আর সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এক অনিশ্চিত জীবনে অভ্যস্ত তারা।
আমরা সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি, এখানকার নারীরা বিশেষ করে যারা কিশোরী ও তরুণী তারা মাসিক স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে সচেতনতার অভাবে নানারকম শারীরিক সমস্যায় পড়েন। এই গ্রামে কোন ফার্মেসী নেই, নেই আধুনিক কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্যাড কেনার সামর্থ্য না থাকায় তারা এখনও পুরনো কাপড় বা অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। সামাজিক ট্যাবু ও পুরুষশাসিত সংস্কৃতিতে তারা নীরব থাকেন, লজ্জিত থাকেন এবং ভোগেন।
এই বাস্তবতাকে বদলাতেই Hashimukh Somaj Kallayan Songstha এবং IPDC Finance Ltd. একসাথে হাতে নেয় যার নাম “Sustainable Menstrual Hygiene and Women Empowerment” প্রকল্প। আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায়, হাসিমুখ সমাজ কল্যাণ সংস্থা, খুলনার দূরবর্তী দাকোপ নামক এই প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে জলবায়ুজনিত কারণে প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়, সেখানে একটি রূপান্তরমুখী কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল দাকোপ উপজেলার কিশোরী ও নারীদের জন্য পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য-সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা, পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড তৈরি ও বিনামূল্যে তা বিতরণ করা , সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য আয়ের পথ তৈরি করা এবং স্থানীয় নারী নেতৃত্ব, দক্ষতা ও সামাজিক স্বীকৃতি বৃদ্ধি করা।
আমাদের এই পথচলাটি মোটেও সহজ ছিল না। প্রকল্পটি শুরু হওয়ার কথা ছিল জুনে। কিন্তু প্রকৃতি তো থেমে থাকেনি। অবিরাম বৃষ্টি, নদীভাঙন আর ঝড় আমাদের পেছনে ফেলে দেয়। অবশেষে জুলাই ২০২৫, আমরা ঢাকার পথ পাড়ি দিয়ে ট্রাক, বাস, ফেরি আর ট্রলারের সমন্বয়ে খুলনার দাকোপ উপজেলার নলিয়ান গ্রামে পৌঁছাই। গ্রামে গিয়ে আমরা পাই এমন নারীদের, যারা জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছেন কিন্তু সাহস হারিয়ে হার মানেননি।এই অগ্রণী প্রকল্পটি নারীদের ঋতুস্রাবজনিত স্বাস্থ্য, জলবায়ু সহনশীলতা এবং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপুর্ণ সন্ধিক্ষণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। আমরা তাদের হাত ধরে শিখিয়েছি পুনঃব্যবহারযোগ্য প্যাড তৈরির কৌশল। আমরা তাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের গল্প শুনেছি এবং এ গল্প আমরা রেখেছি আপনাদের শোনানোর জন্য। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কিশোরী ও মা, যারা হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য তারা পাবেন পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড এবং ঋতুস্রাবজনিত স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগ। এই প্রকল্পের আওতায় প্রতি মাসে ১০০জন এবং প্রতি বছরে ১২০০জন মা ও কিশোরী নারীকে পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রদান করা হবে।
শুরুতে আমরা স্থানীয় প্রতিনিধির সহায়তায় ৪০ জন নারীকে নির্বাচন করি। এরপর তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করি ও স্বাস্থ্যবিধি সচেতনতা তৈরি করি। আমরা দেখতে পাই, তাদের মধ্যে রয়েছে সংগ্রামী মানসিকতা ও নতুন কিছু শেখার প্রবল আগ্রহ। আমরা তাদের সেলাই মেশিন ইনস্টল করে দেই এবং হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করি। তাদের আগ্রহ ও দ্রুত শিখার মানসিকতা আমাদের মুগ্ধ করে। এরপর তারা স্যাম্পল তৈরি করে এবং আমরা আমাদের বিশেষজ্ঞ দ্বারা তার গুণগত মান যাচাই করি। আমরা দেখতে পাই তাদের মধ্যে অনেক নারী ও তরুণী খুব অল্প সময়ে পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড তৈরি করা শিখে ফেলেছে। আমরা এই পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড বিনামূল্যে সে গ্রামের মানুষদের মাঝে বিতরণ করি। এছাড়াও, কীভাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে প্যাড উৎপাদন করা যায় সেই বিষয়ে ২০ জন নারীকে দেওয়া হয়েছে, হাতে কলমে প্রশিক্ষণ। এর মাধ্যমে তারা একটি টেকসই জীবিকা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আমরা দিয়েছি স্বাস্থ্য সচেতনতা সেশন, তাদের বিভিন্ন ভুল ধারণা ভাঙা এবং তাদেরকে নানাভাবে সাহস জোগানো। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে নারীদের শুধু স্বাস্থ্যেগত উন্নয়নই হচ্ছে না বরং এই প্রকল্পের মাধ্যমে দাকোপ অঞ্চলের নারীদের সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক স্বাধীনতাও জোরালোভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাসিককে ঘিরে আমাদের সমাজে যে ট্যাবু রয়েছে, হাসিমুখের এই প্রকল্প সেই ট্যাবু ভেঙে তৈরি করেছে একটি প্রগতিশীল এবং কর্মসংস্থান নির্ভর সামাজিক মডেল।
দাকোপ উপজেলা অত্যন্ত প্রত্যন্ত একটি জায়গায় অবস্থিত। এইখানে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হয় নানা ধরনের প্রতিকূলতা। তাই আমরা সে অঞ্চলের কিশোরী ও নারীদের জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা সমাধানে সে অঞ্চলের নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় “সেলস আপা” ও সুপারভাইজর নিয়োগ করি যারা এই কার্যক্রমটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে তাদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যা কিনা সে অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছে।
এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আমরা শিখেছি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করা অর্থ শুধু একটি প্রকল্প চালানো নয়, বরং এটি মানুষের সাথে একাত্ম হওয়ার একটি উপায়। একই সাথে আমরা বুঝেছি স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন একসাথে করলে নারীরা বদলে দিতে পারেন গোটা সমাজ। তাই আমরা পরিকল্পনা করছি ভবিষ্যতে খুলনা ও সাতক্ষীরার আরও অঞ্চলে এই মডেলটি ছড়িয়ে দিবো, নকশি কাঁথা, সেলাই, হস্তশিল্প শেখানোর মাধ্যমে নারীদের আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবো, ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-কমার্স এর মাধ্যমে নারীদের তৈরি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করার ব্যাবস্থা করবো এবং নারী নেতৃত্বে পরিচালিত সেলফ-হেল্প গ্রুপ গঠন করবো।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, এসডিজি ৩(সুস্বাস্থ্য), ৫(লিঙ্গসমতা), ৮(সদ্বব্যবহারিক কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি), ১২(পরিবেশবান্ধব ব্যবহার ও উৎপাদন), ১৩(জলবায়ু সংরক্ষন পদক্ষেপ) এর আলোকে এই উদ্যোগ গড়ে তুলেছে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি সহনশীলতা ও নারী সমতার এক শক্ত ভীত। হাসিমুখ গত এক দশকে ২.৫ লাখ মানুষের জীবন স্পর্শ করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি নারী যখন সচেতন হন, সাবলম্বী হন, তখন তার চারপাশ বদলে যায়। আর এমন শত নারীর হাত ধরে বদলায় পুরো দেশ। IPDC-এর সাথে মিলে এ প্রকল্প সেই মানবিক উদাহরণ যেখানে উন্নয়ন শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং প্রতিটি হাসিমুখের গল্প।
When you bring together those who have, with those who have not – miracles happen. Become a time hero by volunteering with us. Meet new friends, gain new skills, get happiness and have fun!
Becoming a contributor to a non-profit organization offers a rewarding opportunity to make a positive impact on a cause you care about. By providing your time or resources, you can be a part of meaningful change and help those in need. It also allows you to connect with like-minded individuals, fostering a sense of purpose and fulfillment.